উপজেলা নির্বাচন: অংশ নেবে না বিএনপি, থাকবে আন্দোলনে

কামরুল হাসান :

বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে বিএনপি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও একই সিদ্ধান্ত বহাল রাখতে বদ্ধপরিকর দলের হাইকমান্ড। তৃণমূল বিএনপির নেতাকর্মীরও আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ নেই।

৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে বিপর্যস্ত নেতাকর্মীরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন নিজেদের আত্মরক্ষায়। মামলা-হামলা আর কারা নির্যাতন শেষ করে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা। একই সঙ্গে ‘একতরফা ও ডামি নির্বাচন’ বাতিল করে শিগগির নির্দলীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাবে বিএনপি।

দলটির কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানান, এ মুহূর্তে আরেকটি নির্বাচনের কর্মযজ্ঞে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা যেমন নেই, তেমনি নতুন করে মামলা-হামলার ক্ষেত্র তৈরি করার ইচ্ছাও নেই। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যেমন বিরোধী দলের নেতাকর্মীর ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে, বিভিন্ন প্রলোভন দেওয়া হয়েছে, তেমনি এসব নির্বাচনেও নেতা ভাগিয়ে নেওয়া, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া এবং প্রলোভন দেওয়া হতে পারে বলেও শঙ্কা রয়েছে দলের হাইকমান্ডের। সে ক্ষেত্রে দলটির সিনিয়র নেতারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, তারা এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবেন না বলে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেখানে তারা অটল রয়েছেন। ৭ জানুয়ারির মতো নির্বাচনী খেলায় অংশ নেওয়ার কোনো মানে নেই। এ ধরনের নির্বাচনের বিষয়ে তৃণমূলেরও কোনো আগ্রহ নেই বলে তিনি মনে করছেন।

রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্নের পর এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। দ্রুত সময়ের মধ্যে এই নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হতে পারে। মার্চ মাসে শুরু হয়ে কয়েক দফায় এই নির্বাচনের ভোট গ্রহণ চলবে। মার্চে প্রথম দফায় ভোট গ্রহণ করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ।

গত মঙ্গলবার বিকেলে আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ভবনে তিনি বলেন, রোজা শুরুর আগে প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে পারে।

বিএনপি নেতারা জানান, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা যাবেন না– এমন সিদ্ধান্ত তাদের বলবৎ রয়েছে। সেখান থেকে তাদের এখনই সরে আসার কোনো কারণ নেই। সে রকম কোনো সম্ভাবনাও নেই। এই সরকার ও তাদের নির্বাচন কমিশনের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের যেমন কোনো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি, তেমনি আগামীতে হবে, সে রকমটাও তারা মনে করছেন না। যার বড় প্রমাণ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ‘একতরফা’ নির্বাচনে তারা একদিকে ‘ডামি প্রার্থী’, ‘ডামি এজেন্ট’, ‘ডামি ভোটারে’র আয়োজন করেছে, তেমনি ‘ডামি ফলাফল’ও ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে এই নির্বাচন কমিশনের ওপর তাদের ন্যূনতম কোনো আস্থা নেই।

জানা গেছে, গত মঙ্গলবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় দলের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক এবং সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। দলটির কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, সংসদ নির্বাচন বর্জন করে এখন উপজেলা নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হবে না। কারণ, নির্বাচনে গেলে নেতাকর্মীর ওপর নতুন করে হামলা-মামলা বাড়বে। তাছাড়া, এই সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না, তা বারবার প্রমাণিত। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তা ফের প্রমাণিত হয়েছে। ফলে নির্বাচনে গিয়ে জয়লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই, আবার আন্দোলনের মূল দাবিও দুর্বল হয়ে পড়বে।

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, বিএনপি কলঙ্কিত জাতীয় নির্বাচন বর্জনের আন্দোলনে আছে। এখন উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করা নিয়ে দলের নেতাকর্মীর তেমন কোনো আগ্রহ নেই। ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন বর্জন বা অংশগ্রহণেরও কিছু নেই। এর পরও কৌশলগত কোনো বিষয় থাকলে দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

একই বিষয়ে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবেদিন ফারুক বলেন, এ নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না– তা ৭ জানুয়ারি প্রমাণিত হয়েছে। সিইসি জাতীয় নির্বাচনের দিনে ঘুম থেকে উঠে একবার ২৬, আরেকবার ৪১ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে ঘোষণা দেন। বাস্তবে ৪ শতাংশ ভোট পড়েছে। তাই তাদের ওপর আস্থা রাখার আর কোনো সুযোগ নেই। তাঁর ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, কোনো অবস্থাতেই বর্তমান সরকার ও ইসির অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত নয়।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ‘এক দফা’ দাবিতে ২০২২ সাল থেকে রাজপথে নামে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। দলটি ২০২১ সালের মার্চের পর সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। বরং দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তৃণমূলের অনেক নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

এর মধ্যে ২০২২ সালে বিএনপি নেতা তৈমূর আলম খন্দকার ও মনিরুল হক সাক্কু নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এর বাইরে আরও অনেক নেতা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় একই ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় দলটি। যাদের বেশির ভাগ নেতা নিজেদের ভুল স্বীকার করে দলে ফেরার আবেদন করেও ফিরতে পারছেন না। আগামীতেও দলের এমন কঠোর মনোভাব বহাল রাখা হবে বলে বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানিয়েছেন।

দলটির দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, ঢাকার মহাসমাবেশ ঘিরে সারাদেশে ২৭ হাজার ৪৮৫ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নেওয়া হয়। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি দলের হামলায় আহত হন ৪ হাজার ৩০০ এবং মৃত্যুবরণ করেন একজন সাংবাদিকসহ ২৮ জন। এছাড়া এ সময়ের মধ্যে মামলা হয়েছে ১ হাজার ১৭৫টি। যাতে এজাহারনামীয় আসামি ১ লাখ ৫ হাজার ৭৫ জন।

এ ছাড়াও দলটির দাবি, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৩৪ মামলায় বিএনপির ৪৯ লাখ ৪০ হাজার ৪৯২ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। নতুন-পুরোনো এত মামলার ভারে বিপর্যস্ত বিএনপির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল। এর মধ্যে বেশির ভাগ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা।

দলের নেতাকর্মীরা জানান, ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে তৃণমূলের সাংগঠনিক কাঠামো অনেকটা ভেঙে পড়েছে। বাড়িঘরছাড়া নেতাকর্মী এখনও ঘরে ফিরতে পারেননি। এর ওপর একের পর এক ‘গায়েবি’ মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, সাজা, রিমান্ডের নামে নির্যাতনে বেশির ভাগ নেতাকর্মী নাজেহাল অবস্থায় আছেন। একটি স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরে না আসা পর্যন্ত নির্বাচন তো দূরের কথা, রাজনৈতিক কর্মসূচিতেই সক্রিয় হতে পারছেন না তারা।

চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির সদস্য সচিব শরীফুজ্জামান শরীফ বলেন, দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে তাদের চলমান আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। যেখানে তৃণমূল নেতাকর্মীরা নিজেদের সর্বোচ্চ উজাড় করে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, সেখানে নির্বাচন কমিশনের পাতানো ও হঠকারী নির্বাচন নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই।

বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব মিজানুর রহমান চুন্নু সিকদার বলেন, দেশের পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকেই নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। ভোটের ফল আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে। সরকারি দলের কালো টাকা, পেশিশক্তি আর প্রশাসনিক শক্তির কাছে সবাই অসহায়। সেখানে ভোটারদের মতামতের কোনো মূল্য নেই। এখন দল যদি নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তারা সেটা মেনে নেবেন।